(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) প্রায় দুই মাস আন্দোলন শেষে পুরোদমে কাজে ফিরলেও কপালে চিন্তার ভাঁজ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের। চরম আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে অফিস করছেন বলে জানিয়েছে একাধিক কর্মকর্তা। চাপা আতঙ্কে অফিসজুড়ে ভারী হচ্ছে নিশ্বাস।
এনবিআরের অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও চেয়ারম্যানের অপসারণ আন্দোলনে সক্রিয় থাকা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সম্প্রতি বরখাস্ত করা হয়েছে। এতে বাকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে গভীর শঙ্কা ও উদ্বেগ।
আন্দোলন পরবর্তীতে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় । কর্মকর্তারা বলছেন, আমরা আমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেছি এটিই যে আমাদের জন্য কাল হয়ে ওঠবে তা আমরা কল্পনাও করিনি। অফিস করছি ঠিকই, কিন্তু কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না। এক ধরনের ভয়-শঙ্কা কাজ করছে। এভাবে তো অফিস করা যায় না ভাই…।
তারা জানান, সোমবার (৭ জুলাই) এনবিআরের চেয়ারম্যানের এক বক্তব্যে শঙ্কা আরও বাড়িয়েছে। চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেছেন, ‘এনবিআরের কর্মকর্তাদের ভয়ের কিছু নেই। যারা অনেক বড় আকারে সীমা লঙ্ঘন করেছে, সেটি ভিন্নভাবে দেখা হবে। সাধারণভাবে কারও কোনো ভয়ের কারণ নেই।’ এই ‘ভিন্নভাবে’ দ্বারা তিনি একপ্রকার হুমকি দিয়েছেন। এছাড়া ‘ভয়ের কিছু নেই’ এই কথায়ও কর্মকর্তারা আশ্বস্ত হতে পারছে না।
তারা জানান, ইতঃপূর্বে অর্থ উপদেষ্টাও কথা রাখেননি। গত রোববার (২৯ জুন) রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়ডরহীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। চলছে বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত ও বদলি।
আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমরা যখন আন্দোলন প্রত্যাহার করি তখন আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, কোন প্রতিশোধমূলক শাস্তি দেওয়া হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর, বদলি করা হয়েছে অনেককে। এতে এক ধরনের উৎকণ্ঠা কাজ করছে কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে।
অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যস্ততায় আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করি। তারপর এনবিআরের সংকট নিরসনে সরকার পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। কার্যত এখানেও কোনো ফল নেই। এখন পর্যন্ত কোনো আন্দোলনকারীকে ডাকা হয়নি।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবারও (৩ জুলাই) এনবিআরের দুই কমিশনারসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে। এই পাঁচ কর্মকর্তা হলেন— বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. কামারুজ্জামান, ঢাকা পূর্ব কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, আয়কর বিভাগের অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা, উপ-কর কমিশনার মো. মামুন মিয়া ও কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ।
সব মিলিয়ে এনবিআরের ২ জন সদস্যসহ ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তাদের অধিকাংশই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। আন্দোলন প্রত্যাহারের পর এ পর্যন্ত তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কাজ বন্ধ রাখার দায়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় কর্মরতদের মধ্যে যদি নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক থাকে, তাহলে তা রাজস্ব আদায়ের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সূত্র জানায়, আন্দোলনে সরব থাকা কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। যদিও সরকার আশ্বস্ত করছে যে, কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তবু সেই আশ্বাসেও আস্থা পাচ্ছেন না অনেকেই।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমরা অফিস করছি, কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কে কখন বদলি বা বরখাস্ত হয়, এই ভয় যেন পিছু ছাড়ছে না।
এনবিআরের আন্দোলন নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সংলাপের ইঙ্গিত দিলেও মাঠপর্যায়ে তার কোনো ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বলে কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন। তারা মনে করছেন, সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে কর্মপরিবেশ আরও উত্তপ্ত হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় কর্মরতদের মধ্যে যদি নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক থাকে, তাহলে তা রাজস্ব আদায়ের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অফিসে ফিরে এসেও অনেক কর্মকর্তা মুখ খুলছেন না, আন্দোলনের স্মৃতি ও পরিণতি তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সংলাপ, আস্থা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি সমাধান দ্রুত জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে এনবিআরে এমন আতঙ্ক পরিস্থিতির বিষয়টি ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। আর ব্যবসায়ীদের মধ্যস্ততায়ই মূলত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক একজন সভাপতি জানিয়েছেন, আমরা আন্দোলনকারী এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথমে মিটিং করি। তাদের সঙ্গে বসে আমাদের মোটামুটি আলোচনা হল। তারপরে গেলাম অর্থ উপদেষ্টার কাছে। তো বললাম যে তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করবে, আমাদের কথা দিছে। ওদের একটু ভয়ভীতি কাজ করতেছে।
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, আমরা বলেছিলাম, তাদের দোষ থাকতে পার, এগুলোতে এখন হাত দিয়েন না। তাহলে হয় কি, একটা ইমপ্রেশন হবে যে আন্দোলনের জন্য তাদের শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে তারা কথা রাখেনি।
এদিকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তারা বেশি ফেঁসে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। এনবিআর বিলুপ্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে কঠিন শাস্তির মুখে পড়েছেন তারা। চাকরি বাঁচাতে এরই মধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন কয়েকজন। কেউ আবার যোগাযোগ করছেন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে। অধিকাংশ কর্মকর্তাই আন্দোলনকে ভুল আখ্যা দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
যাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে:
যাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে তারা হলেন- এনবিআর সদস্য আলমগীর হোসেন, হোসেন আহমদ ও আবদুর রউফ এবং কমিশনার মো. শব্বির আহমেদ। সদস্য ও কমিশনার হলো রাজস্ব প্রশাসনের এনবিআরের চেয়ারম্যানের পরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। আদেশে বলা হয়, তাদের চারজনের চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সরকার জনস্বার্থে তাদের সরকারি চাকরি থেকে অবসর প্রদান করে।
আবদুর রউফ ভ্যাট আইন এবং কর কমিশনার শব্বির আহমেদ আয়কর আইন প্রণয়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা এনবিআরের ভ্যাট ও আয়কর আইন ও নীতিবিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, শব্বির আহমেদ ঢাকার কর অঞ্চলের কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এনবিআর সংস্কারের বিষয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কয়েক মাস আগে তাকে বরিশাল কর অঞ্চলে বদলি করা হয়। এবারের আন্দোলনের সময় তিনি আন্দোলনকারীদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সোচ্চার ছিলেন।
অন্যদিকে কাজ বন্ধ রাখার দায়ে গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। জানা গেছে, তিনিও আন্দোলনকারীদের সমর্থন করেন এবং মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচিতে অংশ নেন।
এদিকে যারা নিয়ন মেনে অফিস করবেন তাদেরকে অভয় দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, অফিস স্বাভাবিক হচ্ছে। প্রত্যেকে যদি দায়িত্বশীল আচরণ করে, ঠিকভাবে কাজ সম্পন্ন করে তাহলে তাদের ভয়ের কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। যেসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সেটি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। আন্দোলন তো ওই কয়েকজনে করেনি, অনেকে করেছে। সবার বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, এনবিআরের যৌক্তিক সংস্কার ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে প্রথমে মে মাসে ও দ্বিতীয় দফায় জুনের শেষ সপ্তাহে আন্দোলন করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সারাদেশের কাস্টম অফিস, বন্দর বন্ধ রেখে গত ২৮ ও ২৯ জুন কমপ্লিট শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালন করেন তারা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে পালন করা হয় এসব কর্মসূচি। পরে ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় গত ২৯ জুন আন্দোলন স্থগিত করে এনবিআর ঐক্য পরিষদ। -ডেস্ক রিপোর্ট