(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) ২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। মোট দুটি অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া একটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল সোমবার (১৭ নভেম্বর) বেলা পৌনে তিনটার দিকে রায় ঘোষণা করেন।
ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
রায়ে শেখ হাসিনা ছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালেরও ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। পাঁচ অভিযোগেই তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মামলার অন্য আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল লঘুদণ্ড হিসেবে তাকে এই সাজা দেয়।
রায় ঘোষণার সময় জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নিহত সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা সামছি আরা জামান, মীর মুগ্ধর ভাই মীর স্নিগ্ধসহ কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। আরও ছিলেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন। আদালত কক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ, বসার আসন ভরে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে রায় শোনেন অনেকে।
সকাল ১১টার দিকে রায় পড়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দেড় ঘণ্টা দেরি হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার পর রায় পড়া শুরু করেন বিচারক।
শুরুতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আনতে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানান।

প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা, ডিফেন্স আইনজীবী, স্বাক্ষী, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, শহীদ পরিবারের সদস্য, সাংবাদিকসহ যারা সহযোগিতা করেছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ জানান।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার বলেন, এই রায় ৪৫৩ পৃষ্ঠার এবং ছয় ভাগে রায় ঘোষণা হবে। এরপর রায়ের সারংশ পড়া শুরু হয়।
১২টা ৪৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের সদস্য মো. মোহিতুল হক রায় কিছু অংশ পড়ে শোনান। এরপর আরও কিছু অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনালের আরেক সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ।
পরে রায়ের মূল অংশ এবং উপসংহার পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার।
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বার্তা সংস্থা রয়টার্স রায় ঘোষণা সরাসরি সম্প্রচার করে। ট্রাইব্যুনালের ফেসবুক পেজ থেকেও সরাসরি মামলার রায় ঘোষণা দেখানো হয়। পাশাপাশি ঢাকার দশটি পয়েন্টে বড় পর্দায় দেখানো হয় রায়ের কার্যক্রম।

দেড় দশক ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে দেশ শাসন করা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ (প্রসিকিউশন) সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি করে। আদালত সম্মতি জানালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবার যেকোনো রাষ্ট্র বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হলো।
রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনালে আনা হয় সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনকে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের আদালতে আনা সম্ভব হয়নি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় আন্দোলনকারী, আহত, প্রত্যক্ষদর্শী, চিকিৎসকসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক আবু সাঈদের বাবা, নিহতদের পরিবারের সদস্য, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম, জুলাই আন্দোলনের আরেক নেতা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
এসব সাক্ষ্যের পাশাপাশি প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় শেখ হাসিনার কথোপকথনের অডিও–ভিডিও, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, জব্দ করা গুলিসহ নানা আলামত। এক্ষেত্রে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত ১২ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়।
তিনজনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ
তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়।
প্রথম অভিযোগ: গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর প্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচণা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। গুলি করে দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার।
দ্বিতীয় অভিযোগ: হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। গত বছরের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এএসএম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪-দলীয় জোটের কাছেও এই নির্দেশ চলে যায়। এর আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর দায়ে তাদের (হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন) বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
তৃতীয় অভিযোগ: রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসাদুজ্জামান ও মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়।
চতুর্থ অভিযোগ: রাজধানীর চাঁনখারপুলে আন্দোলনরত নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায়ও শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়।
পঞ্চম অভিযোগ: আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে হত্যার আগুনে পোড়ানোর ঘটনায়ও অভিযুক্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন। -ডেস্ক রিপোর্ট



















