(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উত্তরসূরি বেছে নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংস্থা জাতিসংঘ, যিনি ২০২৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এরই মধ্যে পরবর্তী মহাসচিব নিয়োগের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই পদে মনোনয়ন পাঠানোর জন্য বাংলাদেশসহ ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সংস্থাটি।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদের সভাপতি সদস্য দেশগুলিকে প্রার্থী মনোনীত করার এবং আগামী মাসের মধ্যে পদ্ধতির রূপরেখা দেওয়ার জন্য একটি যৌথ চিঠি জারি করেছেন।
যৌথ চিঠিতে বলা হয়েছে, মহাসচিবের নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কূটনীতি ও ভাষার দক্ষতার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ প্রার্থী খুঁজছেন তারা। প্রার্থীরা একটি রাষ্ট্র বা একাধিক রাষ্ট্রের সমন্বয়ে মনোনীত হতে পারবেন। তাদেরকে একটি ভিশন স্টেটমেন্ট ও অর্থায়নের উৎসের তালিকা জমা দিতে হবে।
জাতিসংঘের ইতিহাসে এখনো কোনো নারী এই পদে আসীন হননি। এই বিষয়টি চিঠিতে উল্লেখ করে সদস্য দেশগুলোকে নারী প্রার্থী মনোনীত করার বিষয়টি দৃঢ়ভাবে বিবেচনা করার জন্য জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ঐতিহ্যগতভাবে মহাসচিবের পদটি অঞ্চলভিত্তিক ঘুরে আসে। ২০২৬ সালে বর্তমান মহাসচিব গুতেরেস (পর্তুগাল) নির্বাচিত হওয়ার সময় পূর্ব ইউরোপের পালা ছিল। এবার লাতিন আমেরিকার পালা বলেই মনে করা হচ্ছে, যদিও অন্যান্য অঞ্চল থেকেও প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেন আশা করছেন কিছু কূটনীতিক।
এদিকে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন প্রকাশ্যে প্রার্থীতা ঘোষণা করেছেন:
মিশেল ব্যাচেলেট (চিলি)
গত ২৩ সেপ্টেম্বর চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বরিক দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাচেলেটকে মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যাচেলেট দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং দুই দফায় দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও ২০১০-২০১৩ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ নারী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ২০১৮-২০২২ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

রেবেকা গ্রিনস্পান (কোস্টারিকা)
চলতি অক্টোবর মাসের শুরুতে কোস্টারিকা প্রেসিডেন্টে রদ্রিগো চ্যাভেস দেশটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রেবেকা গ্রিনস্প্যানকে মনোনীত করার ঘোষণা দেন। ৬৯ বছর বয়সী রাজনীতিবিদ এবং অর্থনীতিবিদ গ্রিনস্প্যান বর্তমানে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএসিটিএড) মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

রাফায়েল গ্রোসি (আর্জেন্টিনা)
জাতিসংঘ পরিচালিত আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি দীর্ঘদিন বৈশ্বিক সংস্থাটির মহাসচিব হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গত সেপ্টেম্বরে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক সাক্ষাতকারে যখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি তা করব, হ্যাঁ।’ একজন অভিজ্ঞ আর্জেন্টিনার কূটনীতিক গ্রোসি ২০১৯ সাল থেকে আইএইএর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

এ ছাড়াও বৈশ্বিক সংস্থাটির মহাসচিব পদে সম্ভাব্য প্রার্থী বা ‘রিউমারড পটেনশিয়াল ক্যান্ডিডেটস’ হিসেবে আরও কয়েকটি নাম আলোচনায় রয়েছে।
সম্ভাব্য প্রার্থী যারা
জেসিন্ডা আরডার্ন (নিউজিল্যান্ড)
নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নকে প্রথম নারী মহাসচিব পদে দেখতে চান অনেকে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্য দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে আরডার্নকে ‘জাগ্রত কর্তৃত্ববাদী’ এবং ‘অভিজাত জনগণের রাজকন্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং তিনি জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন বলে পূর্বাভাস দিয়েছে।

আলিসিয়া বার্সেনা (মেক্সিকো)
সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন মেক্সিকোর পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক মন্ত্রী আলিসিয়া বার্সেনা। দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্সেনার জাতিসংঘে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। লাতিন আমেরিকার অর্থনৈতিক কমিশনের (ইসিএলএসি) নির্বাহী সচিব হিসেবে দায়িকত্ব পালন করেছেন তিনি।
ডাভিড চোকেউয়াঙ্কা (বলিভিয়া)
বলিভিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আদিবাসী রাজনীতির শক্তিশালী মুখ গ্লোবাল সাউথের ‘অন্য কণ্ঠস্বর’ হিসেবে বিবেচিত ডাভিড চোকেউয়াঙ্কা সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন।
এছাড়াও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চতুর্থ নারী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মারিয়া ফার্নান্দা এস্পিনোসা গারসেস, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বুলগেরিয়ান অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এবং ২০১৬ সালের নির্বাচনে বর্তমান মহাসচিব গুতেরেসের প্রতিদ্বন্দ্বী, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাবেক সভাপতি ও সার্বিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুক ইয়েরেমিচও সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন।
কীভাবে নির্বাচন হবে?
১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ গোপন ব্যালটে ভোট দেবে, যাকে স্ট্র পোল বলা হয়- যতক্ষণ না তারা একজন প্রার্থীর বিষয়ে ঐকমত্য হয়। প্রতিটি সদস্য প্রার্থীর পক্ষে ‘সমর্থন’, ‘অসম্মতি’ বা ‘মত নেই’ ভোট দিতে পারে। পরে সেই প্রার্থীর নাম সাধারণ পরিষদের কাছে সুপারিশ করবে নিরাপত্তা পরিষদ। ২০১৬ সালে যখন গুতেরেসকে সাধারণ পরিষদে সুপারিশের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল, তখন নিরাপত্তা পরিষদের একমত হতে ছয়টি স্ট্র পোল লেগেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স — এই পাঁচ স্থায়ী সদস্যের (ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন) ঐকমত্যই এখানে মুখ্য।
নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশ পাওয়ার পর সাধারণ পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীর নিয়োগ অনুমোদন করবে, যা ঐতিহ্যগতভাবে আনুষ্ঠানিকতাই মাত্র। কারণ সাধারণ পরিষদ কখনও নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক সুপারিশকৃত প্রার্থীকে নিয়োগ করতে অস্বীকৃতি জানায়নি, তাই বলা যেতে পারে যে নিরাপত্তা পরিষদের নির্বাচন জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব নির্ধারণ করে।
মহাসচিবের দায়িত্ব কী?
জাতিসংঘের সনদে মহাসচিবকে বিশ্ব সংস্থাটির ‘প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ বলা হয়েছে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে এই ভূমিকাকে ‘সমান ভূমিকার কূটনীতিক এবং আইনজীবী, বেসামরিক কর্মচারী এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
গুতেরেস বর্তমানে ৩০ হাজারেরও বেসামরিক কর্মী এবং ১১টি শান্তিরক্ষা কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন, যেখানে প্রায় ৬০ হাজার সেনা ও পুলিশ সদস্য রয়েছেন। জাতিসংঘের মূল বার্ষিক বাজেট ৩.৭ বিলিয়ন ডলার, যেখানে শান্তিরক্ষা বাজেট ৫.৬ বিলিয়ন ডলার।
যেহেতু সামরিক ব্যবস্থা বা নিষেধাজ্ঞার অনুমোদন নিরাপত্তা পরিষদের হাতে, তাই মহাসচিবের ক্ষমতা সীমিত। অনেকে কূটনীতিক বলেন, নিরাপত্তা ভেটো ক্ষমতাধারী পাঁচ স্থায়ী সদস্য এমন কাউকেই পছন্দ করেন, যিনি ‘জেনারেল’- এর চেয়ে ‘সচিব’ ভূমিকা বেশি পালন করবেন।
জাতিসংঘের ৮০ বছরের ইতিহাসে কোনো নারী মহাসচিব হননি
সম্প্রতি সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে কোনো নারী এখনো মহাসচিব পদে নির্বাচিত হননি’। সদস্য দেশগুলো যেন নারীদের প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে সেই আহ্বান জানানো হয়েছে। সূত্র: রয়টার্স, ওয়ান ফর এইট বিলিয়ন



















