(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দমাতে গোয়েন্দাদের বিশাল ব্যর্থতা ছিল বলে জানিয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান তিনি। সাক্ষাৎকারে আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, ৫ ও ৬ আগস্ট তিনি ঢাকায় ছিলেন এবং ৭ আগস্ট বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। একইসঙ্গে এটিকে সেনা অভ্যুত্থান বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে, আসাদুজ্জামান খান কামালের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের পর তার বক্তব্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যাচার বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে প্রেস উইং ফ্যাক্ট চেক পেইজে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রকাশিত গণহত্যার পলাতক আসামি আসাদুজ্জামান খান কামালের সাক্ষাৎকার মিথ্যাচার এবং ভুল তথ্যে পরিপূর্ণ। ভারতে আত্মগোপনে থাকা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তথ্য যাচাই না করেই তার মিথ্যাচার প্রচার করেছে।’
আসাদুজ্জামান খান কামাল বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে ধারণা করা হয়। সেখানকার সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
প্রশ্ন: চলমান পরিস্থিতি থেকে আওয়ামী লীগ কোথায় যাবে? দলটি ঘুরে দাঁড়াবে কীভাবে?
উত্তর: আমি বাংলাদেশে ১০ বছর ৬ মাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলাম। এই সময়কালে অনেক উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করেছি। এখন সবকিছু ৩৬০ ডিগ্রি উল্টে গেছে। গত বছরের ৩ থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে প্রায় ৪৬০টি থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ৫ হাজার ৮২৯টি অস্ত্র থানাগুলো থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন থেকে এসএসএফের (ভিভিআইপি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) অস্ত্রও নিয়ে যাওয়া হয়। আমি নিজে ৫ ও ৬ আগস্ট ঢাকায় ছিলাম এবং ৭ আগস্ট বাড়ি থেকে বের হয়েছি’।
প্রশ্ন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আপনি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। আপনি কি এই পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেননি?
উত্তর: যখন থানাগুলো পুড়েছে কার্যত পুলিশ তখন অকার্যকর হয়ে যায়। তখন জাতির কেবল নিঃশব্দে দেখা আর মৃতদেহ গোনা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পুলিশই নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়। কিন্তু যদি পুলিশই পঙ্গু হয়ে যায়, তখন কী হবে? আমি বলব এটি ছিল একটি যৌথ অভ্যুত্থান। এটি ইসলামি উগ্রবাদ এবং সেনাবাহিনীর যৌথ অভ্যুত্থান।
প্রশ্ন: স্পষ্টতই, একটি বিশাল গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল। একজন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আপনি কি এটি স্বীকার করেন?
উত্তর: আমি একমত যে একটি গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল, তা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাই হোক। তবে এটি ছিল একটি সেনা অভ্যুত্থান। সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ গোয়েন্দা ইউনিট আছে, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)। তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাও (এনএসআই) সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করে। এমনকি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কেবল গোয়েন্দা রিপোর্টের সারসংক্ষেপ আসে।
প্রশ্ন: আপনি কি স্বীকার করেন যে, আপনার দল এমন কিছু মৌলিক ভুল করেছে, যা অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে?
উত্তর: আমি একে ভুল বলব না। তবে হ্যাঁ, আমরা আমাদের দল পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করেছি। এটাই সমস্যা। দুই বছর পরপর নতুন নেতাদের উঠে আসা উচিত। কিন্তু আমরা সময়মতো নেতাদের নির্বাচন করতে পারিনি।
প্রশ্ন: আপনার দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ হচ্ছে?
উত্তর: আমি তার সাথে দেখা করতে পারি না, তবে ফোনে তার সাথে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলি, দিকনির্দেশনা চাই। ৪ আগস্ট প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে ছিলাম। পুলিশপ্রধান সেখানে ছিলেন। সেনাপ্রধানও সেখানে ছিলেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে কিছুই ঘটবে না, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখব।
তিনি বলেছিলেন, ‘আপনার সুরক্ষা আমার দায়িত্ব।’ আমি এসবের সাক্ষী। আমি তাকে আবারও জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কি পুরো দায়িত্ব নিচ্ছেন? তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ। এরপর আমি আমার অধীনে থাকা পুলিশপ্রধানকে বলেছিলাম যে তিনি যেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনভাবে আলোচনা করেন এবং সবকিছু যেন স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু আপনারা ৫ আগস্ট যা ঘটেছিল তা দেখেছেন।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের কর্মীরা দেশের বাইরে লুকিয়ে আছেন; অনেকেই জেলে। আপনি কীভাবে তাদের মনোবল ধরে রাখবেন?
উত্তর: আওয়ামী লীগ কর্মীদের মনোবল অত্যন্ত উঁচু। তারা শেখ হাসিনা ছাড়া ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারে না। তিনিই বাংলাদেশকে পরিবর্তন করেছেন। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলায় পরিবর্তন এনেছেন।
প্রশ্ন: আপনি ভারতের কাছ থেকে কী আশা করেন? ভারত কীভাবে সাহায্য করতে পারে?
উত্তর: আমি মুক্তিযোদ্ধাদের একজন কমান্ডার ছিলাম, তাই আমি জানি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে ভারত কী করেছে। আমি স্বীকার করি, ভারত সবসময় বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। এখন ভারত কূটনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারে। আমাদের আদালতগুলো পঙ্গু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে যেতে পারছেন না। সব বিচারক নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাই প্রথম কাজ হলো কূটনৈতিক চাপ দেওয়া এবং উচ্চস্বরে দাবি তোলা, যাতে আদালতগুলো আবার কার্যকর হয়। ভারত এতে সাহায্য করতে পারে।
প্রশ্ন: আপনার এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ কী?
উত্তর: আমার একমাত্র ছেলে জেলে। আমার অনেক আত্মীয় ভালো অবস্থায় নেই। আমার ছেলে কাশিমপুরের একটি কারাগারে রয়েছে, যেখানে আমরা একসময় সন্ত্রাসীদের আটক রাখতাম। কয়েকদিন পরপর, বর্তমান সরকারের কেউ সেখানে গিয়ে আমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কোথায় অবস্থান করছি। আর আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
আমার বিরুদ্ধে প্রায় ২৯০টি হত্যা মামলা হয়েছে। এটি নিশ্চয়ই একটি রেকর্ড, হয়ত আন্তর্জাতিক রেকর্ডও। ৫৪টি মামলায়, যারা হত্যার শিকার হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তারা জীবিত ফিরে এসেছেন… এই মামলাগুলোতে আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, আমি এবং আরও বেশ কয়েকজন নেতার নাম রয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি কি দেশে ফিরে আইনের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত? আওয়ামী লীগ কি নির্বাচন লড়তে প্রস্তুত?
উত্তর: আমি ফিরে যেতে ভয় পাই না। তবে সেটি কেবল তখনই সম্ভব, যখন আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, বিচারকরা স্বাধীনভাবে মামলা শুনতে পারবেন এবং আমাদের পক্ষের আইনজীবীরা আমাদের পক্ষে লড়তে পারবেন। আমরা নির্বাচনে বিশ্বাস করি। আমরা অবশ্যই নির্বাচন লড়ব, যদি সেখানে যেতে পারি।
প্রশ্ন: শেখ হাসিনা নির্বাসনে, এবং আওয়ামী লীগের অধিকাংশ শীর্ষ নেতৃত্ব গোপনে। দলকে সংগঠিত করা কতটা কঠিন হবে?
উত্তর: কিছুই অসম্ভব নয়। আমি বিশ্বাস করি এটি সম্ভব। এবং আমি বিশ্বাস করি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সবকিছু বদলাবে। বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে আমি দেশটিকে দেখেছি, বাংলাদেশের মানুষকে দেখেছি, এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমরা খুব শীঘ্রই এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব। আমাদের অনেক নেতার অবস্থান আমরা জানি না… কিন্তু যদি আমরা আন্দোলন শুরু করি, বিক্ষোভ শুরু করি, তাহলে তারা আবারও এগিয়ে আসবে।
আমার বয়স ৭৫ পেরিয়ে গেছি, এখন আমি বোনাস জীবনে আছি। আমি ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। আমি বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগের তরুণ নেতারাও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। এখন সময় এসেছে তরুণ নেতাদের এগিয়ে আসার।
প্রশ্ন: এই অস্থিরতায় গণমাধ্যমের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর: গণমাধ্যম সম্পূর্ণভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে। গণমাধ্যম কিছু মন্তব্য করতে পারে না। তারা কোনো কিছুর জন্য আওয়াজ তুলতে পারে না। তারা এখন নীরব। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা যদি সবাইকে এগিয়ে আসার জন্য বলেন, তা অবশ্যই হবে।
প্রশ্ন: শেখ হাসিনার সঙ্গে আপনার কথা হলে, কী বলেন তিনি?
উত্তর: তিনদিন আগে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা সব নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলো এবং আমরা অবশ্যই খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠব।’
প্রশ্ন: আপনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কী বার্তা দিতে চান?
উত্তর: তার চেয়ারে বসার কোনো অধিকার নেই। তিনি নেতা নন, রাজনীতিক নন। আমাদের দেশে খুব অদ্ভুত কিছু ঘটেছে। বাংলাদেশ একটি অদ্ভুত দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। ড. ইউনূসের উচিত তার পদ ছেড়ে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে লড়তে দেওয়া। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এটিই একমাত্র উপায়।
-অনলাইন ডেস্ক